জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বিদ্যমান পাঠ্যক্রম প্রজন্মকে মেধা ও চরিত্রহীন করে তুলছে। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা কতটা ভয়াবহ ও নৈরাজ্য তা সচেতন মহল অবগত। যে শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষিত, মার্জিত, দেশপ্রেমিক ও ধার্মিক একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠার কথা, সে শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাগত, নীতিগত ও চরিত্রগত এমন সামগ্রিক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। যা দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও মননের সাথে সাংঘর্ষিক এক শিক্ষাব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে।
শিক্ষা একজন নাগরিককে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও পেশাগত জীবনে সৎ, দায়িত্ববান, ধর্মপরায়ণ ও দেশপ্রেমী হতে সাহায্য করে। আর এটা নিশ্চিত করা হয় দেশের জনগণের বোধ-বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতি রেখেই। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় তা উপেক্ষিত থেকে গেছে। বরং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা হতে ধর্ম ও নৈতিকতাকে সরিয়ে ফেলে, মৌলিক দর্শন হিসেবে ব্রাহ্মণ্যবাদ, সেক্যুলারিজমকে ও ধর্মহীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বুধবার (১০ জুলাই) সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি হলে ‘বিতর্কিত জাতীয় পাঠ্যক্রম; দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকদের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ নেতারা এসব কথা বলেন।
এদিকে বিতর্কিত শিক্ষা সিলেবাস বাতিলের দাবিতে ৮ দফা দাবি ৩ ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জাতীয় আইম্মা পরিষদ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- মাসব্যাপী জেলায়-জেলায় বিতর্কিত পাঠ্যক্রম ইস্যুতে ওলামা, শিক্ষাবিদ ও সূধি সম্মেলন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে থানায় থানায় ওলামা ও সূধি সম্মেলন, সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিতর্কিত পাঠ্যক্রম বাতিলের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় সম্মেলন।
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরুল হুদা ফয়েজীর উপস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক মুফতী রেজাউল করীম আবরারের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সহ-সভাপতি ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসাইন। এসময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের নেতা মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, মুফতি মোহাম্মদ আলীকাসেমী, মুফতী হেমায়েতুল্লাহ কাসেমী, মুফতী কেফায়েতুল্লাহ কাশফী, মাওলানা শামসুদ্দোহা আশরাফী, মুফতি ইসমাঈল সিরাজী, মাওলানা কামাল উদ্দিন সিরাজ, মুফতি রফিকুন্নাবী হক্কানী, মুফতী আব্দুল আজিজ কাসেমী, মাওলানা শাহজাহান আল হাবিবী, মাওলানা মঈনুদ্দীন খান তানভীর, মুফতী ফরিদুল ইসলাম, মাওলানা নুরুল করীম আকরাম, মুফতী জোবায়ের আব্দুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা মাহবুবুর রহমান আশরাফী।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত ৮ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- বিতর্কিত জাতীয় পাঠ্যক্রম বাতিল করে যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কিরামের সমন্বয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করা। বিতর্কিত ও ইসলাম বিরোধী বিষয়সমূহ বাদ দেওয়া। পাঠ্যপুস্তক বিজাতীয় সংস্কৃতি, অনৈসলামিক শব্দ এবং অশ্লীল চিত্র মুক্ত রাখা। মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলাম মাদরাসা সংশ্লিষ্ট আলেম ও ইসলামিক স্কলারদের দ্বারা পরিমার্জন করা। আলিয়া মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্র কারিকুলাম প্রণয়ন করা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্ব-স্ব ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ট্রান্সজেন্ডার কোটা বাতিল ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা নিশ্চিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা। ‘কৃষি শিক্ষা’ ও ‘গার্হস্থ্য বিজ্ঞান’ শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে বাধ্যতামূলক করা।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সেই শিক্ষার ভীত যদি দুর্বল, জাতিসত্তা বিরোধী ও নৈতিকতাহীন নিরেট বস্তুবাদী হয়; তাহলে জাতি ভুল পথে পরিচালিত হবেই। আদর্শ শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে যেভাবে দেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস, ধর্মীয় আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল, দু:দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও শিক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সুচিন্তিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কখনোই সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। শিক্ষাখাতে বার্ষিক বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। শিক্ষকদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা কতটা নাজুক তা শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর দিকে তাকালে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তাছাড়া বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে অনেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
এমতাবস্থায় নীতি-নৈতিকতার প্রধান চালিকাশক্তি ধর্মীয় শিক্ষাকে পরিকল্পিতভাবে সংকুচিত করাসহ নানারূপ অসঙ্গতিপূর্ণ বিতর্কিত কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। শিক্ষা কমিশনের জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রয়োগ ও বাতিল দেখতে দেখতে জাতি আজ ক্লান্ত ও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সর্বশেষ ভিনদেশের শিক্ষাক্রম অনুকরণ করে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন জাতির সঙ্গে উপহাস বৈ কিছু নয়।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, সকলের মেধা ও প্রতিভা কখনই এক হবে না। কিন্তু সরকার, অভিভাবক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের লক্ষ্য ও প্রতিভার বিভিন্নতা বিবেচনা না করে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে একমুখী মডেলে তৈরি করতে চান। ফলে জাতি হিসেবে আমরা আরো পিছিয়ে পড়বো।