দেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ আগস্ট (সোমবার) থেকে দেশের পূর্বাঞ্চলে টানা তিন দিন অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে, গত ৫৩ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের আটটি জেলা ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের জন্য ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। অনেকের মতে, হঠাৎ অতি ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢল, জলাশয় ভরাট এবং পানি সরে যাওয়ার জলপথ সংকীর্ণ হওয়ার জন্য খুব দ্রুত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বন্যা পরিস্থিতি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত পূর্বাঞ্চলে আগস্ট মাসে এত ভারি বৃষ্টি হয় না। বিশেষ করে মাসের শেষের দিকে টানা বৃষ্টি হলেও সাধারণত তা দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে মধ্যাঞ্চলজুড়ে থাকে। এর আগেও আগস্টে ফেনী ও কুমিল্লায় অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি এক-দুদিনের বেশি। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে থেমে থেমে গত এক মাসে অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত। ভারি বৃষ্টি হয়েছে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও।
এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে বাংলাদেশে চলমান বন্যার জন্য মূলত চারটি প্রাথমিক কারণ উল্লেখ করেন কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে পিএইচডি গবেষক আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ।
এগুলোর মধ্যে প্রথমত কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি লঘুচাপটি স্থায়ী হয়ে আছে। এ লঘুচাপটি বুধবার (২১ আগস্ট) বিকালেও চট্টগ্রামের অংশে অবস্থান করছিল যা পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না। এর প্রভাবে দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানা গেছে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে খুবই শক্তিশালীভাবে ম্যাডেন-জুলিয়ান অসিলেশন (এমজেও) বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। যে কারণে নিয়মিত গরম ও আর্দ্র বাতাস তৈরি হচ্ছে সাগরে, যা প্রবাহিত হচ্ছে উপকূলের দিকে।
তৃতীয়ত, ‘জেট স্ট্রিম’ এখন মধ্য এশিয়ার উপরিভাগে অবস্থান করছে। যে কারণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে ভারতসহ বাংলাদেশে।
চতুর্থত, ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়াটা বন্যা ভয়াবহ রূপ নেয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। ভারতীয় অংশেও ভারি এবং উজানের এই দেশটিও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বিপৎসীমায় পৌঁছে যাওয়ায় বন্যার কবলে পড়েছে। বন্যার আক্রান্ত হলেই প্রতি বছর বাঁধ খুলে দেয় ভারত। এ বছরও কোথাও কোথাও তারা বাঁধ খুলে দিয়েছে এবং অতিরিক্ত পানির কারণে কিছু জায়গায় বাঁধের গেটগুলো ভেঙে গেছে।
এ তিনটি কারণ একই সঙ্গে ঘটলে তখন ওই এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায় এবং এর ফলে পাহাড়ি ঢল ও বন্যার সৃষ্টি হয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন মোস্তফা কামাল পলাশ। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুন মাসে দেশে এই তিনটি কারণ একই সঙ্গে ঘটেছিল এবং চট্টগ্রাম এর কেন্দ্র ছিল। যার ফলে সেই বছর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মারা যায় শতাধিক মানুষ।
পলাশ বর্তমান পরিস্থিতিতে সতর্ক করে বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় বৃহস্পতিবার রাত ১২টার মধ্যে ১০০-৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এই বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা আছে আগামী শুক্রবার (২৩ আগস্ট) থেকে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ সাম্প্রতিক বন্যার জন্য দু’দিন আগে একটি নিম্নচাপ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তৈরি হয়ে ঘনীভূত হওয়াকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দুদিন আগে সুস্পষ্ট লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছিল। লঘুচাপের ডান দিকে অর্থাৎ, সিলেট ও চট্টগ্রামে অস্বাভাবিকভাবে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে, অন্যদিকে উষ্ণ, মৌসুমি বায়ুর কারণে অন্যান্য এলাকায় বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে কম ছিল। এমনটা সাধারণত ঘটে না।’
এদিকে আরও খারাপ বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। দেশের আরও জেলা বন্যাকবলিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।