আবারও ইরানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে দুইবারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রোববার (২ জুন) তিনি নিবন্ধন করেছেন। এরপরই তার ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে।
আগামী বছর ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত মে মাসে আকস্মিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান রাইসি। এতে হঠাৎ ইরানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সেই শূন্যতা পূরণে কে হবেন ইরানের পরবর্তী কাণ্ডারি সেই অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ববাসী।
কারণ, তেহরানের মসনদ হচ্ছে একটি জ্বলন্ত উনুন, সেখানে যে-ই বসুক না কেন, তাকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে হবে। আর আঞ্চলিক আরব শত্রুরা তো রয়েছেই।
প্রেসিডেন্ট পদ শূন্য হওয়ার পর ইরানের আইনের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ২৮ জুন আগাম প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। এই নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এ দৌড়ে নাম লিখিয়েছেন প্রায় ৪০ জন প্রার্থী।
তবে ইরানের আইন খুব শক্ত ও জটিল। দেশটিতে কেউ সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। তাকে গার্ডিয়ান কাউন্সিলের বাছাই পার হতে হয়। মূলত নিবন্ধনকারী সবার ভাগ্য ঝুলে আছে গার্ডিয়ান কাউন্সিলের হাতে। এ কাউন্সিলের অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যক্তিই প্রেসিডেন্ট পদের জন্য চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামতে পারবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ১১ জুন যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করবে কাউন্সিল।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্য সব প্রার্থীর মতো মাহমুদ আহমেদিনেজাদের ভাগ্যও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের হাতে। তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হতে হলে তাকে এ কঠিন পথটি পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে জল্পনা চলছে, এবার অন্তত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি মিলবে তো? যদি না মিলে তবে নিবন্ধনের মধ্যেই আটকে যাবে আহমেদিনেজাদের ভাগ্য।
এ আশঙ্কার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় গার্ডিয়ান কাউন্সিল। তার ইশারা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, খামেনি যাকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চান তিনিই কাউন্সিলের বাছাই পার হতে পারেন।
অর্থাৎ, খামেনির সঙ্গে ভালো সম্পর্কই আহমেদিনেজাদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম করবে, নয়তো নয়।
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রাক্তন সদস্য আহমেদিনেজাদ ২০০৫ সালে প্রথম দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয় ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে আহমেদিনেজাদের দিনকাল সহজ ছিল না। তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দেশে ও দেশের বাইরে চাপে পড়েন তিনি। এ সময় ত্রাণকর্তার মতো আহমাদিনেজাদকে আগলে রেখেছিলেন খামেনি।
২০০৯ সাল পরবর্তী ওই সময়ে আহমাদিনেজাদকে সমর্থন করেছিলেন খামেনি। আহমাদিনেজাদবিরোধী বিক্ষোভ দমাতে রেভল্যুশনারি গার্ডস কোর (আইআরজিসি) মোতায়েন করা হয়। খামেনির নির্দেশে কঠোরভাবে ওই বিক্ষোভ দমানো হয়। দেশব্যাপী কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
কিন্তু ধীরে ধীরে আহমাদিনেজাদের সঙ্গে খামেনির দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে দুজনের মধ্যে মতবিরোধ প্রকট হয়। ইরানের ‘একনায়ক’ খ্যাত সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি।
এক পর্যায়ে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে আহমাদিনেজাদকে দূরে থাকতে বলেন খামেনি। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে প্রার্থী হতে নিবন্ধন করেন তিনি। ওই নিবন্ধন বাতিল করে গার্ডিয়ান কাউন্সিল। এতে খামেনির কাছে আহমাদিনেজাদের অপছন্দনীয় হয়ে উঠার প্রমাণ মেলে।
কারণ, গার্ডিয়ান কাউন্সিল অলিখিতভাবে খামেনির প্রতিনিধি। খামেনি যাকে চান তাকে মনোনীত করাই কাউন্সিলের কাজ। এ কাউন্সিলের ওপর খামেনির আধিপত্য একচ্ছত্র।
এরপর আহমাদিনেজাদের সঙ্গে খামেনির বিরোধের ফাটল আরও বাড়ে। বিভিন্ন বক্তব্যে আহমাদিনেজাদ ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। ২০১৮ সালে খামেনির সমালোচনায় সিদ্ধহস্ত হন আহমাদিনেজাদ। যা দেশটিতে বিরল।
ওই সময় আহমেদিনেজাদ ‘মুক্ত’ নির্বাচনের দাবি তোলেন। এ বিষয়ে তিনি আহ্বান জানিয়ে খামেনিকে চিঠি লিখেছিলেন।
এরপর দীর্ঘ সময় কাটলেও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাবেক এ প্রেসিডেন্টের সম্পর্কের উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। তাই ইরানেই ছড়িয়ে পড়েছে যে, এবারও প্রার্থী হওয়ার প্রাথমিক ধাপ পার করতে পারবেন না আহমেদিনেজাদ।
এ শঙ্কা থেকে সাংবাদিকরা আহমেদিনেজাদকে প্রশ্ন করেন, এবারও অযোগ্য ঘোষিত হলে কী করবেন তিনি? জবাবে হেসে দেন তিনি। বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন না। সারা দেশের মানুষের কাছ থেকে একটি আহ্বান শুনে এখানে এসেছি।’ নির্বাচিত হলে ইরানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো সমাধানে আত্মবিশ্বাসী বলে জানান তিনি।