ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে।
মতিউরের ঘনিষ্ঠ একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রোববার (২৩ জুন) বিকেলে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন তিনি।
এর আগে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া কোরবানি উপলক্ষে ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কিনে আলোচনার জন্ম দেন মুসফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ। পরে জানা যায় ইফাত এনবিআরের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে কর্মরত মতিউর রহমানের ছেলে।
এরপরই একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল পরিমাণ টাকায় গরু-ছাগল কেনা নিয়ে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে মতিউর রহমান দাবি করেন, ইফাত তার ছেলে নন। এমনকি এই তরুণ তার পরিচিতও নয়। এই ঘটনার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্যাডার পরিবর্তন করে বাণিজ্য ক্যাডারের ১১ ব্যাচ থেকে কাস্টমসের ১৩ ব্যাচের সঙ্গে চাকরিতে যোগ দেন ড. মতিউর রহমান। নতুন ক্যাডারে যুক্ত হওয়ার পরই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্পদ বাড়তে থাকে তার। ড. মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তার। সাবেক এক চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবে। সেই সময় বিভিন্ন কোম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য এনবিআর ও দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুই প্রতিষ্ঠান।
ইফাতের ছাগল কেনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়। মতিউর রহমান এই তরুণকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করলেও ইফাতের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন তার পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। আর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন মতিউর রহমানের দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা। ইফাত মতিউর রহমানের সন্তান না হলে তার পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কীভাবে পেল—এমন প্রশ্ন উঠে। সেইসঙ্গে একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন—সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
মতিউর রহমানের দাবি, তার সব সম্পদ বৈধ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার মাধ্যমে অর্জিত। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার এবং এর বাইরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারত্বের নথিপত্র এসেছে। এসব নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজীপুরের গ্লোবাল সু ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার মালিকানা রয়েছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন মতিউর রহমান। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস ইন্ডাস্ট্রিজে। ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। শুধু ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নয়, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন নামে পুঁজিবাজারের আরেক কোম্পানিতে ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ শেয়ার রয়েছে।
জানা গেছে, মতিউর রহমান বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায় থাকেন। তার পারিবারিক মালিকানাধীন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসও ওই এলাকায়। এ ছাড়া মতিউর রহমানের ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এদিকে, ছাগলকাণ্ডের পর মতিউরের পাশাপাশি তার দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামেও সম্পদের খোজ পাওয়া যায়। এমনকি শাশুড়িকেও করে দিয়েছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি।
জানা যায়, মতিউরের প্রভাবে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী। বর্তমানে তিনি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কীভাবে এত সম্পদ গড়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এলাকার মানুষ। তবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও স্বামীর প্রভাবের কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। এরপর প্রকাশ্যে আসে মতিউরের শাশুড়িকে ফেনীতে ডুপ্লেক্স বাড়ি করে দেওয়ার খবর। জানা যায়, মতিউরের সেই ছেলে ইফাত ও স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবুর অনুরোধে ফেনীর সোনাগাজীতে শাশুড়িকে একটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়ে উপহার দেন মতিউর।
মতিউর রহমানের দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ি সোনাগাজী উপজেলার সোনাপুর এলাকায়। প্রায় ১০ বছর আগে তৈরি ওই বাড়িটিকে স্থানীয়রা মিয়া বাড়ি হিসেবে চেনেন।
মতিউরের বানিয়ে দেওয়া বিলাসবহুল বাড়িটি জসিম উদ্দিন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, ১০-১২ বছর ধরে তিনি এ বাড়ি দেখাশোনা করছেন। সর্বশেষ দুই মাস আগেও মতিউর রহমান, স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবু, ছেলে ইফাত ও শাশুড়িকে নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। দুদিন থাকার পর আবার ঢাকায় ফিরে যান। মতিউরের শাশুড়ি বর্তমানে ঢাকায় মেয়েদের বাসায় ও বাড়িতে আসা-যাওয়ার ওপর থাকেন। তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।