প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর নিয়ে দেশটির প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার এই সফর দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে।
বেইজিং-ভিত্তিক রাষ্ট্রায়ত্ত ইংরেজি ভাষার নিউজ চ্যানেল চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিজিটিএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ও বাংলাদেশ তাদের সম্পর্ককে একটি ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। খবর বাসসের।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে এক বৈঠকে এই ঘোষণা দেন।
বৈঠকে শি উল্লেখ করেন যে চীন-বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী যাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আদান-প্রদান হাজার বছরের প্রাচীন।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশ সবসময় পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখেছে এবং ও পরস্পরকে সমর্থন দিয়েছে। একে অপরের সাথে শ্রদ্ধাশীল আচরণ এবং ‘উইন-উইন’ সহযোগিতায় নিয়োজিত রয়েছে।
শি বলেছেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর মধ্যে এটি বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময় এবং পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতার একটি সুন্দর উদাহরণ স্থাপন করেছে।
তিনি বলেন, চীন আগামী বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’র আওতায় চলমান উচ্চমানের সহযোগিতাকে আরও গভীর করার, সহযোগিতার নিবিড়তা ও পরিধি সম্প্রসারণের সুযোগ হিসেবে নিতে এবং চীন-বাংলাদেশ ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের উন্নয়নে প্রস্তুত রয়েছে।
শি জোর দেন যে উভয় পক্ষের উচিত পারস্পরিক সহায়তার চমৎকার ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক পারস্পরিক বিশ্বাসকে আরও গভীর করা।
তিনি বলেন, একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলা, নিজস্ব জাতীয় অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উন্নয়নের পথে চলা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখ-তা রক্ষায় এবং কোনো বহিঃ হস্তক্ষেপের বিরোধিতায় চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করে।
শি বলেন, চীন বাংলাদেশের সাথে দলীয় ও রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং উন্নয়ন নীতি বিনিময়, দুই পক্ষের মধ্যে উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় জোরদার এবং বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও আন্তঃসংযোগ সহযোগিতা গভীর করতে প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশের সাথে শিল্প, বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করতে দুই দেশের মধ্যে শিল্প ও সরবরাহ চেইনের উন্নয়ন এবং বাংলাদেশকে তার জাতীয় উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য আরও চীনা বাণিজ্য সমর্থন করে। সিজিটিএন রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে শি আগামী বছর ‘জনগনর সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের বছরকে’ সামনে রেখে দুই দেশকে সংস্কৃতি, পর্যটন, মিডিয়া ও খেলাধুলার মতো ক্ষেত্রে বিনিময় ও সহযোগিতার জন্য উভয় পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
সিজিটিএন বেইজিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে বৈঠকের বিষয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বৈঠকে, চীন ও বাংলাদেশ বুধবার চীন-বাংলাদেশ মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তির ওপর যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয় এবং উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তিকে আপগ্রেড করার বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়।
দুই নেতা নীতি বিনিময়, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল অর্থনীতি, পরিদর্শন ও কোয়ারেন্টাইন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং মিডিয়া বিষয়ে বহু দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করেন এবং ২০২৫ সালকে চীন-বাংলাদেশ ‘জনগণ-জনগণ’ বিনিময় বর্ষ হিসেবে নামকরণ করতে সম্মত হন।বৈঠকে লি ও হাসিনা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করার অঙ্গীকার করেন।
পিপলস ডেইলি ‘চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নত, সহযোগিতা বিস্তৃত করছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা শেখ হাসিনার চীন সফরকে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের অভিযাত্রা হিসেবে বর্ণনা করেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোন তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে নয় এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ায় সামগ্রিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে।
গ্লোবাল টাইমসও এ সফর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফেং বলেন, শেখ হাসিনার এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিশেষ করে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার উন্নয়নে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি যোগসূত্র।
কিয়ান বলেন, দুই দেশের উন্নয়ন কৌশল আরও সমন্বিত করা হবে, এবং দুদেশের কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যে আরও সারগর্ভ সংকেত ব্যঞ্জনা সঞ্চার করতে ভবিষ্যতে আরও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিয়ান বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাস্তবসম্মত সহযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য চীনের সৎ-প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বের ধারণার অধিকতর উপলব্ধি, উন্নয়নের ফল ভাগাভাগি করার ধারণা এবং একটি দায়িত্বশীল প্রধান শক্তি হিসেবে চীনের ভাবমূর্তি অনুধাবনের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়ন কোনো তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্য করে নয় উল্লেখ করে কিয়ান বলেন, চীন সবসময় শূন্য-ফল খেলার বিরোধিতা করে এবং পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতার পক্ষে অবস্থান নেয়।
কিয়ান বলেন, জটিল ভূ-রাজনীতির পটভূমিতে চীন বাংলাদেশের কৌশলগত পছন্দকে সম্মান করে এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে তার কোনো আপত্তি নেই। সাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের গবেষণা ফেলো হু ঝিয়াং বলে, ‘শেখ হাসিনার চীন সফর দুই দেশের মধ্যে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে আরও উন্নত করবে।’
হু বলেন, বিগত বছরগুলোতে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে দেখেছে যে চীনের উন্নয়ন ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিশেষ করে, বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণে চীনা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, বাংলাদেশে স্থানীয় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণে চীনের সহায়তা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের মাত্রা বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।