ফরিদপুর জেলা শহরের আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়নুল আবেদীন টিটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দিয়েছেন দশম শ্রেণির একাধিক ছাত্রী। নিজের ও পরিবারের মানসম্মানের ভয়ে এতদিন তারা মুখ খুলেননি।
রোববার (১৪ জুলাই) দুপুর পৌনে ২টায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে একাধিক শিক্ষার্থীর অবস্থান নিয়েছেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) বরাবর একটি অভিযোগ দেয় শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে অভিযোগের অনুলিপি দেওয়া হয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকেও। কিন্তু অভিযোগ পত্রটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেওয়ার চেষ্টা করেও রিসিপশন থেকে গ্রহণ না করে বরং শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে জেলা শিক্ষা অফিসে জমা দেন শিক্ষার্থীরা।
ফেসবুক মেসেঞ্জারের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক টিটনের এমন কিছু যৌন উত্তেজনাপূর্ণ মেসেজ কালবেলার হাতে এসেছে। পরীক্ষার প্রশ্ন, নগদ অর্থসহ আইফোন উপহারের প্রলোভন দেখিয়ে এমন প্রস্তাব দিতেন তিনি। অতঃপর কৌশলে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে পরে সেগুলোর মাধ্যমে তাদের ব্ল্যাকমেইল করা হত।
জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক হবার পর থেকে গত একযুগের বেশি সময় ধরে বিশেষ করে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা টিটনের এমন লালসার শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে। শ্রেণিকক্ষেই ছাত্রীদের গায়ে হাত দিতেন তিনি। নিজ বাসাই প্রাইভেট কোচিং করানোর সময় শিক্ষার্থীদের একাকী পেলে ছাত্রীদের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়া, ফেসবুক মেসেঞ্জারে উত্তেজনাপূর্ণ আলাপচারিতাসহ পর্ণ ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে বশে আনতেন তিনি। ফাঁদে পড়ে তার সঙ্গে অনেক ছাত্রী ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য হয়েছেন। যারা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হত তাদের টেস্ট পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়ে পাশ করিয়ে দিতো এবং যারা তার কুপ্রস্তাবে রাজি হত না তাদের ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখানো হত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০১২ সালের এক এসএসসি শিক্ষার্থী জানান, জয়নুল আবেদীন টিটন আমাদের প্রধান শিক্ষক হলেও ভালো ম্যাথ পড়াতেন। উনি ক্লাসের মধ্যেই বিভিন্নভাবে গায়ে হাত দিতেন, ভাবতাম এটা তেমন কিছু না কারণ শিক্ষকতো বাবার মত। পরে যখন প্রাইভেট পড়তে ওনার বাসাই যেতাম তখন তিনি, একই কাজ করতেন। গালে, বুকে পেটে হাত দিতেন, টেবিলের নিচে থেকে পা এর মধ্যে পা নিয়ে চেপে ধরতেন। বলতেন আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তোমার ভালো হবে, ভালো রেজাল্ট করতে পারবে। আত্মসম্মানের ভয়ে মুখ খুলতাম না। আমার এসএসসি পরীক্ষার পরেও আমাকে ফোন দিতো। আমি এই শিক্ষক নামের মুখোশধারী শয়তানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
২০১২ সালের আরেক ছাত্রী বলেন, প্রধান শিক্ষকের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে প্রতিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া হত। এক পর্যায়ে আমার দুই বান্ধবী জয়নুলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। বিষয়টি মানসম্মানের ভয়ে তারা চেপে গেছেন। তার অপকর্মের কথা বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক কর্মচারীও জানেন। তবে সবাই তার অধীন হওয়ায় চাকরি হারানোর ভয়ে কেউই মুখ খোলেন না।
বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী কালবেলাকে জানান, প্রধান শিক্ষক ক্লাসে পড়ানোর সময় বিভিন্ন ইস্যু বের করে আমাদের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়। আমরা এগুলো কাউকে বলতে পারি না। আমাদেরকে মেসেঞ্জারে বিভিন্নভাবে খারাপ ছবি দিয়ে লোভ লালসা দেখিয়ে আমাদের প্রলোভন দেখাতো। আমরা স্ক্রিনশট দেখাতে পারব। একজন প্রধান শিক্ষক হয়ে তার এমন আচারণের বিচার আমরা কোথায় পাব? আমরা জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কাছে এসবের একটি অভিযোগ দিতে ডিসি অফিসে যাই কিন্তু রিসিপশনে আমাদের এ অভিযোগপত্রটি না রেখে ফিরিয়ে দিলে জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে অভিযোগ পত্রটি জমা দিয়ে আসি।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, শ্রেণিকক্ষে থাকা বিভিন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা, বিশেষ করে গত ১১ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই করা হলে অনেক কিছুই জানা যাবে। ক্লাস চলাকালীন মেয়েদের শরীরে স্পর্শ করেন প্রধান শিক্ষক। এ বিষয়টি অন্যান্য শিক্ষককে জানালেও তারা ভয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক কালবেলাকে জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক পিতা-মাতা এবং সন্তানের সম্পর্কের মত। যে সব ঘটনা ঘটেছে তা আসলে শিক্ষক হিসেবে আমরা বলতেও লজ্জা পাই। প্রধান শিক্ষকের এমন আচরণ আমরা জানলেও কিছু বলতে পারি না কারণ আমরা তার অধীনে চাকরি করি। প্রধান শিক্ষক অনেক প্রভাবশালী। ডিসি অফিস এবং শিক্ষা অফিসে তার লোকজন আছে। এসব নিয়ে কিছু বললে আমাদের চাকরি থাকবে না। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
অভিযোগের বিষয়ে ফরিদপুর সদরের আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়নুল আবেদীন টিটনের বক্তব্য জানতে এ প্রতিবেদক তার অফিসে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। সেখান থেকেই তাকে একাধিকবার কল করা হলেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহাতাব আলী মেথু কালবেলা বলেন, বিষয়টা আমি শুনেছি কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। শনিবার (১৩ জুলাই) বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার সঙ্গে দেখা করলে আমি তাকে এ বিষয় নিয়ে আজকে মিটিং ডাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বিদ্যালয়ে আসেননি এবং মিটিং এর বিষয়ে কাউকে কলও করেনি। মিটিং কেন ডাকেনি এ বিষয়ে আজ প্রধানশিক্ষককে ফোন দিলে রিং বাজলেও তিনি ফোন ধরেননি। এখন তার নম্বর বন্ধ পাচ্ছি। এর আগে আমি মেয়র থাকা অবস্থায়ও এ ধরনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আমি ডাক যোগে পেয়েছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগকারী না থাকায় তাকে মৌখিকভাবে সাবধান হবার নির্দেশ দেই।
সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি এবং ফরিদপুর জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি শ্রিপ্রা রায় বলেন, এ প্রধান শিক্ষকে বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে। ঘটনাটি দুঃখজনক। অনতিবিলম্বে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত করা হোক। সেই সঙ্গে তদন্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি করছি। এটা নিয়ে আমরা আজ বিকালে বসে সিদ্ধান্ত নিব কি করা যায়। স্মারকলিপি দিব আমরা। ভুক্তভোগীদের পাশে আমরা আছি।
জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার কালবেলাকে বলেন, আমি দরখাস্ত পেয়েছি অন্যের মাধ্যমে। সরাসরি আমার কাছে কেউ আসে নাই। তদন্ত করব, সত্যতা পেলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷