স্টুটগার্টে গতকাল রাতে কী ঘটেছিল, আরেকবার ফিরে দেখা যাক।
ম্যাচের তখন ১০৫ মিনিট। ১-১ গোলের সমতায় স্পেন ও জার্মানি। স্পেন বক্সের বাইরে থেকে গোল করতে শট নেন জার্মান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার জামাল মুসিয়ালা। বলটি বুলেটগতিতে যাওয়ার পথে বক্সের ভেতর থাকা স্প্যানিশ লেফট ব্যাক মার্ক কুকুরেল্লার বাঁ হাতে লেগেছে। হ্যান্ডবল হওয়ার কারণে সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির আবেদন করেন জার্মানির খেলোয়াড়েরা। কিন্তু রেফারি অ্যান্থনি টেলর পেনাল্টির বাঁশি বাজাননি। আবেদন নাকচ করে দেন। ভিএআর রেফারি স্টুয়ার্ট অ্যাটওয়েলও ব্যাপারটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার পর মাঠের রেফারি টেলরের সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকেন।
ম্যাচটি পরে ২-১ গোলে হেরে ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে স্বাগতিক জার্মানি। ১১৯ মিনিটে মিকেল মেরিনোর গোলে সেমিফাইনালের টিকিট পেয়েছে স্পেন। তবে সেই হ্যান্ডবল নিয়ে প্রশ্ন এড়ানো যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় উঠেছিল কাল রাতেই। হারের পর সংবাদ সম্মেলনে হ্যান্ডবল নিয়ে রেফারির সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেছেন জার্মানির কোচ ইউলিয়ান নাগলসমান। গোলের পথে থাকা বল প্রতিপক্ষের হাতে লাগলেও কীভাবে হ্যান্ডবল হয় না, সে প্রশ্ন তুলে নাগলসমান মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তি এমন সমস্যার সমাধান করতে পারে।
নাগলসমান বলেছেন, ‘এটা নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। তবে লক্ষ্যটি কী (বলের ও হ্যান্ডবল করেছেন যিনি), সেটি মূল্যায়ন করলে ভালো হতো। ধরুন কেউ গ্যালারির দিকে শট নিল এবং বল কারও হাতে লাগল—সেটি কিন্তু পেনাল্টি নয়। ফুটবলে এটি সম্ভব না। কিন্তু বল যখন পরিষ্কারভাবে গোলের পথে ছিল এবং হাতে লাগল, তখন লক্ষ্য নিয়ে কথা বলা অর্থহীন।’
নাগলসমান ব্যাখ্যা করেন, ‘শটের লক্ষ্য কোন দিকে ছিল, সেটি দেখতে হবে। আমাদের কফি এনে দেওয়ার জন্য ৫০টি রোবট আছে। তাই ক্রস, শট কোন দিকে যাচ্ছে, সেসব বিচারের জন্যও এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) থাকা উচিত। এটা বেশ সহজ। শট কোন দিকে যাচ্ছিল, সেটা সত্যিই দেখতে হবে। তবে আমরা শুধু এ কারণেই ম্যাচটি হারিনি।’
এবার সেই পেনাল্টি না দেওয়ার কী ব্যাখ্যা, তা বুঝে নেওয়া যাক। ইএসপিএনের জেনারেল এডিটর ডেল জনসন এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
কুকুরেল্লার হ্যান্ডবল হয়েছিল কি না, সেটি নির্ধারণে শেষ ষোলোয় জার্মানি-ডেনমার্ক ম্যাচের একটি ঘটনা টেনেছেন ডেল জনসন। সে ম্যাচেও ভিএআর রেফারি ছিলেন অ্যাটওয়েল। জার্মানির ডেভিড রাউমের ক্রস ডেনিশ ডিফেন্ডার জোয়াকিম অ্যান্ডারসনের হাতে লাগলে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কুকুরেল্লার ক্ষেত্রে দেননি। কারণ কী?
উয়েফার নিয়ম বলছে, হাত যদি তোলা অবস্থায় (অনুভূমিক) থাকে, তবে সেটি বলের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে, তখন রেফারি কিংবা ভিএআরের স্পটকিক নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া উচিত। উয়েফা যদি মনে করত, অ্যাটওয়েল ডেনমার্ক-জার্মানি ম্যাচে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিয়ে ভুল করেছেন, তবে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে তিনি একই দায়িত্বে থাকতেন না।
ইউরো শুরুর আগে উয়েফার রেফারিদের প্রধান রোবের্তো রোসেত্তি হ্যান্ডবলে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। রোসেত্তি ভিডিওতে দেখিয়েছেন, বল এক খেলোয়াড়ের হাতে লাগছে, যখন সেই ডিফেন্ডারের হাতটি খাড়া বা উলম্ব অবস্থানে এবং শরীরের কাছাকাছি ছিল। রোসেত্তির মতে, এটা পেনাল্টি নয় এবং হাত যদি শরীরের কাছাকাছি থাকে ও সেটি অনুভূমিক অবস্থানে না উঠে বলের গতিপথে বাধা তৈরি না করে, তবে পেনাল্টির শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।
কুকুরেল্লার ঘটনায় আবারও চোখ ফেরানো যাক। মুসিয়ালার শট যখন তাঁর হাতে লাগে, তখন হাতটি নিচে নামানো ছিল। অনুভূমিক বা আড়াআড়ি অবস্থানে ছিল না। উয়েফা নিজেদের প্রতিযোগিতায় হ্যান্ডবল নিয়ে বেশ কড়া হলেও ডিফেন্ডারদের তাঁরা অন্তত এতটুকু স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করছে যেন হাত পেছনে রেখে গোল ঠেকাতে না হয়।
তাই একজন ডিফেন্ডার দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বল তাঁর শরীরের পাশ দিয়ে হাতে লাগলে এবং সেই হাত যদি খাড়া বা উলম্ব অবস্থানে থাকে ও হাতটি শরীরের (বডিলাইন) পেছনে থাকলে সেটি পেনাল্টি দেওয়া উচিত হবে না। কুকুরেল্লার হাত কিন্তু তাঁর বডিলাইনের পেছনেই ছিল।
তবে ডেল জনসন মনে করেন এই নিয়মের ক্ষেত্রে সমস্যাও আছে। সেটি অবশ্য অ্যান্ডারসনের হ্যান্ডবলের অপরাধে দেওয়া পেনাল্টির সিদ্ধান্তটি সামনে রেখে বলেছেন তিনি। অ্যান্ডারসনের হাতে বল লেগেছে খুব কাছ থেকে। আর সে সময় তিনি দৌড়াচ্ছিলেন। সে মুহূর্তে বলটা তাঁর হাতে সামান্য লাগাতেই যদি পেনাল্টি দেওয়া হয় তবে গোলে নেওয়া শট সরাসরি হাতে লাগলে কেন পেনাল্টি দেওয়া হবে না? অন্তত কুকুরেল্লার ঘটনাটি দেখে অ্যান্ডারসনের ক্ষেত্রে দেওয়া পেনাল্টির সিদ্ধান্ত খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয় না বলে মনে করেন ডেল জনসন।
তবে সিদ্ধান্ত পছন্দ হোক বা না হোক, দুটি ঘটনাতেই উয়েফার নিয়ম ও প্রত্যাশা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।