চারটার দিকে জামতলা এলাকার গলিতে রিকশা নিয়ে বের হয় ইমন। সাড়ে চারটার দিকে এলাকার মানুষ মাকে এসে খবর দেয়, ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
গ্রামের বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। ছিল না কাজের সংস্থানও। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমাল ভেঙে রেখে গেছে দোচালা টিনের ঘরটি। ইচ্ছে ছিল, পরিবারের সকলের আয় মিলিয়ে ঘরটি মেরামত করার। মা কুলসুম বিবি ও বাবা নান্টু কাজি ১৪ বছরের ছোট ছেলে ইমনকে রিকশা কিনে দিয়েছিলেন। অলিগলিতে চালিয়ে ভালোই রোজগার করত ইমন। কিন্তু কে জানত, ইমনের রোজগারের টাকায় ঘর মেরামত না করে তা তাকে দাফনে খরচ করতে হবে!
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-কে কেন্দ্র করে ঢাকায় সহিংসতার গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের মধ্যে ইমন একজন। ২০ জুলাই বিকেলে রিকশা নিয়ে বের হওয়ার পর রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয় সে। পরে হাসপাতালে মারা যায় ইমন।
সম্প্রতি ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সাচিয়া গ্রামের কাজি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিধ্বস্ত ঘরের কাছে কালো পলিথিনে জড়ানো ইমনের উঁচু কবরের কাছে বসে বিলাপ করছেন কুলসুম বিবি।
‘আমার পোলারে লইয়্যা গ্যাছে, আমার জানডা কেউ কবজ করে না ক্যা? অত্তটুকু পোলারে গুল্লি মাইররা মাথা ফুটা কইরা দিছে। অ্যাই বিচার কার ধারে দিমু? য্যারা মারছে হ্যাগোরে মুই মাফ করমু না,’ বলতে বলতেই কবর জড়িয়ে ধরেন তিনি।
বাড়ির লোকজন জানান, প্রবল অর্থকষ্টের কারণে আটবছর আগে ঢাকায় পাড়ি জমান কুলসুম-নান্টু দম্পতি। থাকতেন রাজধানীর উত্তর বাড্ডার জামতলা এলাকায়। সংসারে তিনছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট ইমন।
কুলসুম পোশাক কারখানায় আর নান্টু দিনমজুরির কাজ করতেন। অন্য সন্তানেরাও রিকশা-ভ্যান চালান। সকলের সমন্বিত আয়েও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো।
কুলসুম বলেন, কারফিউ ঘোষণার পর আতঙ্কের মাঝেও পেটের দায়ে অনেকে রাস্তায় নেমেছিলেন। ২০ জুলাই শনিবার দুপুরে নিজেই ভাত বেড়ে খাইয়েছিলেন ছেলে ইমনকে।
চারটার দিকে জামতলা এলাকার গলিতে রিকশা নিয়ে বের হয় ইমন। সাড়ে চারটার দিকে এলাকার মানুষ মাকে এসে খবর দেয়, ইমন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
‘খবর হুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে জামতলা গলির ধারে যাই। যাইয়া হুনি হাসপতালে নিছে। গেলাম হাসপাতালে। অনেক খোঁজার পরে পাইলাম, আমার বাজানের লাশ,’ বলেন কুলসুম বিবি।
‘থুতনি দিয়া [গুলি] ঢুইকা মাথা ফুডা হইয়্যা গ্যাছে। আমরা অভাবী মানুষ। আমার পোলাডার কোনো অপরাধ আছিল না। আমিতো আর বুঝি নাই, আমার বাজান হেইদিন মোর হাতে শ্যাষ খাওন খাইছে।’
‘রেমাল নিল ঘরবাড়ি, গুলি নিল মোর বাজানরে’ — ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যান কুলসুম।
‘আমার পোলায়তো মিছিলেও যায় নাই। আমরা প্যাটখিদার [পেটের ক্ষুধা] মানুষ। ঘরের খোরাকি [রোজগার] জোগাইতে পোলায় রাস্তায় নামছিল। কার্ফুর স্যারেরা আইয়্যা গুল্লি মাইরা দিলো। এট্টু বাদবিচারও করল না, রিকশায়ালা মারতাছে ক্যান?’ প্রশ্ন করেন এ শোকাতুর মা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাস্তায় নামলে অন্যরাও গুলিবিদ্ধ হতে পারেন, এ ভয়ে পুরুষ মানুষ সঙ্গে আনেননি কুলসুম — ঢাকা থেকে পরদিন নিজেই ছেলের লাশ নিয়ে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুস ব্যাপারি বলেন, ইমনকে বাড়িতে এনে দাফনের আগে ও পরে পুলিশ এসে খোঁজ-খবর নিয়ে গেছে।
আলীনগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাজাহান বলেন, ‘অভাবের কারণে ইমনেরা ঢাকায় থাকত। মাঝেমধ্যে এলাকায় আসত। দরিদ্র পরিবারে এত বড় ধাক্কা ওরা সইতে পারবে বলে মনে হয় না।’
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, আন্দোলনে সংঘর্ষে ঢাকায় নিহতদের মধ্যে ১৮ জনের বাড়ি ভোলা জেলার বিভিন্ন উপজেলায়।