অবিলম্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে সরকারের অন্যায় আদেশ না মানার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি এবং অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে দলটি।
রোববার (০৪ আগস্ট) সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ আহ্বান জানান। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের এই জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি মহাসচিব। এসময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগে যত দেরি হবে তত বেশি ক্ষতি হবে দেশ ও জাতির এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও ক্ষতি হবে। কারণ সরকার পরিকল্পিতভাবে এ দেশকে ধবংস করেছে। এখনই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এদের পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে এবং তাদের চলে যেতে বাধ্য করতে হবে। এখনই সময় এটার।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে আজ এক গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছে। সারা ঢাকা জনগণের শহরে পরিণত হয়েছে, গোটা দেশ জনতার সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। বিএনপি জাতির এই চরম ক্রান্তিলগ্নে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আপামর জনসাধারণ এবং বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি রাজপথে নেমে এসে ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গণহত্যাকারী স্বৈরাচারী সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে অসহযোগ আন্দোলন সফল করার আহ্বান জানাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাঈদ, মুগ্ধসহ শত শত নিরীহ ছাত্র, শিশু ও জনতার রক্তে অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর হাত রঞ্জিত হয়েছে। জনগণ এ ভয়াবহ গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় বেরিয়ে আসছে। দলমত, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ ফুঁসে উঠেছে ক্রোধে। এখনো কি তাদের (সরকার) বোধদয় হচ্ছে না? আমি প্রার্থনা করি, তাদের সম্বিৎ ফিরে আসুক, শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। আর কোনো রক্তপাত না, আর কোনো সংঘাত না দিয়ে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে তারা সরে যাক। এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলমত সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি, পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষকসহ আপামর জনসাধারণকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বানও জানান তিনি।
সরকার পদত্যাগের প্রক্রিয়া কী হবে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, এই প্রক্রিয়াটা আমরা তখনই দেব আমরা সবার সঙ্গে পরামর্শ করে বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন যারা করছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা পরে এই বিষয়টাকে আপনাদের জানাব। এখনই সেই সময়টা উত্তীর্ণ হয়েছে বলে আমরা মনে করি না।
তিনি বলেন, শুধু সেনাবাহিনীর প্রতি নয়, দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্য সকলের কাছে আমাদের আবেদন তারা কখনই জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। জনগণের রক্তে, ছাত্রদের রক্তে আর যেন আমাদের রাস্তা রঞ্জিত না হয়, আমাদের সন্তানরা যেন শহীদ না হয় সেদিকে তারা অবশ্যই তাদের দায়িত্ব দেবেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তারা কোনো দল বা ব্যক্তির কর্মচারী নয়। তারা অবশ্যই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে জনগণের প্রতি। সেই বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এধরনের অন্যায় নির্দেশগুলো বাদ দিয়ে জনগণের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।
সরকার পদত্যাগ না করলে কী হবে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই পরিস্থিতি কি কোনো দিন কোনো শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে সামলানো সম্ভব হয়েছে? বাংলাদেশের ইতিহাস, পাকিস্তান আমলের যে ইতিহাস সেই ইতিহাসগুলো দেখেন… যখন জনতার আন্দোলন শুরু হয়, জনতার উত্তাল সমুদ্রের সূচনা হয় তখন কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না যে এটা ঠেকিয়ে রাখা। জনতার উত্তাল স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগে আমার স্ত্রী বলেছেন, আমি কি ঘরে থাকব? আমার মেয়েরা চলে গেছে, প্রত্যেকের মেয়েরা চলে গেছে। আমার মনে হয় আপনাদের বাসায়ও এখন আর কেউ নেই… সব বেরিয়ে গেছে। এই যে একটা উত্তাল গণঅভ্যুত্থান- এ গণজাগরণ- এই গণজাগরণ আমরা দেখেছি। ১৯৬৯ সালে আমিই দেখেছি। আমি দেখেছি ’৯০ সালে, আমি দেখেছি ’৭০ এ, ’৭১ এ। আজকে আবার তার চেয়ে অনেকে বেশি শক্তি নিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। দেখুন কয়েকজন ছাত্র- যারা কিন্তু প্রফেশনাল স্টুন্ডেন্ট লিডারও নয়, যারা কোনো ছাত্র সংগঠনও করে না। এরা কিন্তু সমস্ত জাতিগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজকের পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। আদালতকে ব্যবহার করে তারা সবসময় অপকর্মগুলো করেছে। আবারও তারা আদালতকে ব্যবহার করে এ কোটার সমস্যাটাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে- সেখান থেকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটাই হয়। সরকার ব্যর্থ হয়ে যখন অর্থনীতি, রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা থাকে না তখন তার পরিণতি এটাই হয়। এই সরকারকে চলে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এটা কি আওয়ামী লীগ? আমরা যে আওয়ামী লীগকে অতীতে চিনতাম সেটা এই আওয়ামী লীগ নয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকেও ছাড়িয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষের জমায়েতে তারা আজকে হামলা করছে। কত ভয়ংকর হলে এটা করতে পারে? চট্টগ্রামে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাছির উদ্দিন, চট্টগ্রামের মহানগরীর সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন, বর্তমান আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ ও ঢাকায় দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসস্পাদক রুমিন ফারহানা, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সন্ত্রাস চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমরা বলতে চাই, এসব করে তারা সরকারের পতন ঠেকাতে পারবে না। ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত আন্দোলন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত, তাকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা কারও নেই।