বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয় নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক আইজিপি, রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি, নিউমার্কেট জোনের বর্তমান এডিসি, নিউ মার্কেট জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার ও নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাত ৩০-৪০ জন পুলিশ, বিজিবি কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে।
জানা গেছে, বুধবার (২০ আগস্ট) বেলা ১১টায় রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় নিজের সন্তান হত্যার মামলা করতে আসেন প্রিয়র মা শামসি আরা জামান এবং তার বোন তাসফিয়া আলমসহ কয়েকজন বন্ধু।
তাদের দাবি, সাক্ষী-প্রমাণ থাকার পরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। বেলা ১১টা থেকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত জোর প্রচেষ্টার পর রাত সোয়া ১২টার দিকে মামলার আবেদন গ্রহণ করে পুলিশ।
এ বিষয়ে তাহির জামান প্রিয়র মা কালবেলাকে বলেন, বেলা ১১টা থেকে রাত ১২টার পর পর্যন্ত নিউমার্কেট থানায় অবস্থান করেছি। পুলিশ শুরু থেকেই গড়িমসি করছিল, যাতে মামলাটা না নেওয়া যায়। নিউমার্কেট থানায় উচ্চপর্যায়ের যারা আছেন বা যারা ওইদিন হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতা ছিলেন তাদের নাম যেহেতু মামলায় এসেছে, তাদেরও যেহেতু আমরা এ মামলায় জড়িয়ে ফেলেছি, সে জায়গা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য তারা তোড়জোড় করেন। অবশেষে মামলার অভিযোগ থানা গ্রহণ করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী ছেলেরা আজ আমার পাশে না থাকলে এ মামলাটা হয়তো করতে পারতাম না। রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে হলেও সেটা সম্ভব হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, আমি একটু হলেও বিজয় নিয়ে থানা থেকে যেতে পারছি।
এ প্রসঙ্গে নিউমার্কেট থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) অরপিত হালদার বলেন, আমরা নিহত সাংবাদিক প্রিয়র মায়ের করা মামলার আবেদন গ্রহণ করেছি।
মামলার আবেদনে উল্লেখিত আসামিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ-আল মামুন, পুলিশের রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ ইমাম, প্রশাসন ও নিউমার্কেট জোন পুলিশের এডিসি হাফিজ আল-আসাদ, সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. রেফাতুল ইসলাম রিফাত, নিউমার্কেট থানা পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম, ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত অজ্ঞাতনামা ৩০/৪০ জন পুলিশ ও বিজিবি বাহিনীর কর্মকর্তা এবং সদস্যরা।
মামলার এজাহারে প্রিয়র মা উল্লেখ করেন, আমার ছেলে মো. তাহির জামান প্রিয় ১৯ জুলাই আনুমানিক ৪টায় নিউমার্কেট থানাধীন মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি সীমানা সংলগ্ন ল্যাবএইড সেন্ট্রাল রোড এলাকায় ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঘটনাস্থলে আসে। নিউমার্কেট থানাধীন এলিফ্যান্ট রোডের সেন্ট্রাল রোডের গলির মাথায় (দক্ষিণ-পূর্ব কোণে) আমার ছেলে ভিকটিম মো. তাহির জামান প্রিয় এবং মামলার দুই সাক্ষীসহ (তানভীর আরাফাত ধ্রুব ও সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ) ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত অবস্থায় তাদের উদ্দেশ করে পুলিশ প্রাণঘাতি বুলেট ছুড়তে থাকে।
এতে আরও বলা হয়, আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিলেন এবং তারা কোনো ধরনের স্লোগান, মিছিল বা চিল্লাচিল্লি করেনি। সে সময় মিরপুর রোড ধরে রেফাতুল ইসলাম রিফাত ও আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত অজ্ঞাতনামা আসামিরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহাম্মদ আশরাফ ইমামের নির্দেশে পুলিশের একটি গ্রুপ ল্যাবএইডের দুই বিল্ডিংয়ের মাঝের রাস্তায় ঢুকে পড়েন। ছাত্র-জনতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৩০/৪০ জনের পুলিশ বাহিনীর একটি গ্রুপ দ্রুত পিছন থেকে গ্রিন রোডের মুখে চলে আসে। আমার ছেলেসহ অসংখ্য ছাত্র-জনতা সেন্ট্রাল রোডের মাথায় শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন আমার ছেলে উলফাৎকে বলছিল যাইহোক ‘আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো’। সবাই পুলিশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে যান এবং সাক্ষীগণসহ সবাই হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান। ধ্রুব দেখেন, ক্রমাগত আকাশ পথে নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টার ও ড্রোন থেকে আন্দোলনকারীদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছে এবং সে ঘটনার ভিডিও ধারন করতে করতে ঘটনাস্থলের দিকে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যেতে থাকলে অজ্ঞাতনামা আসামি কর্তৃক গুলি ছোড়ার আওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এ সময় ধ্রুব সেন্ট্রাল রোড ও গ্রিন রোডের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে দেখেন যে পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনরত ২৫-৩০ জন ছাত্র সায়েন্সল্যাবের দিক থেকে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজমুখী সেন্ট্রাল রোডের ভিতরে ঢুকে অবস্থান নেয়। পুলিশের একটি দল সায়েন্স ল্যাবের দিক থেকে এবং অপর একটি পুলিশের দল ল্যাব এইডের দুই ভবনের মাঝের রাস্তা ধরে ওয়াই শেইপে সেন্ট্রাল রোড অভিমুখী একসঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরক্ষণে দেখা যায়, পুলিশের পোশাক পরিহিত অজ্ঞাতনামা আসামিরা হাঁটু গেড়ে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে থাকেন।